জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ
আব্দুন নাসের খান
প্রত্যাশিত ব্যবহার ও উপযোগিতা অনুযায়ী মানুষের জন্য বিশুদ্ধ ও স্বাস্থ্যসম্মত আহার্যই নিরাপদ খাদ্য। অনিরাপদ খাদ্য শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণই নয় বরং দেহে বিভিন্ন রোগের বাসা বাধারও কারণ। নিরাপদ খাদ্য মানুষের অন্যতম প্রধান মৌলিক অধিকার। তাই আমাদের খাদ্য নিরাপদ, পুষ্টিকর ও সুষম হওয়া প্রয়োজন। নিরাপদ খাদ্য একদিকে দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পথ সুগম করে। দীর্ঘজীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাবার অত্যাবশ্যক।
সকলের জন্য পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (ঝউএ) এর লক্ষ্যমাত্রা ২, ৩, ৬, ৮, ১২ এবং ১৭ নিরাপদ খাদ্য নিশ্চয়তার সাথে সম্পর্কিত। সরকার এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তিতে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। খাদ্য শৃঙ্খলের শুরু হতে ভোক্তা পর্যন্ত দূষণ ও ভেজালমুক্ত নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ প্রণীত হয়। এই আইন বাস্তবায়নে খাদ্যের পুষ্টিমান ও নিরাপদতা নিশ্চিতকল্পে সরকারের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী সংস্থা বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৫। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানামুখী কার্যক্রম চলমান রয়েছে। জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সকলের জন্য নিরাপদ খাদ্য। ব্যবস্থাপনা করাই হচ্ছে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের রূপকল্প।
কৌশলগত লক্ষ্য
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক দ্বিতীয় মেয়াদে ৫ (পাঁচ) বছর (২০২২-২০২৬) মেয়াদী কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে :
া কৌশলগত লক্ষ্য ১ : সামগ্রিক নিরাপদ খাদ্য ইকোসিস্টেম সমন্বয়ের জন্য বিএফএসএ কে একটি একক নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
া কৌশলগত লক্ষ্য ২ : নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশের বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা আমলে নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক মান প্রতিষ্ঠা করা।
া কৌশলগত লক্ষ্য ৩ : বাংলাদেশে একটি কার্যকর ও স্বচ্ছ কাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণমূলক প্রতিপালন পদ্ধতি শক্তিশালী করা।
া কৌশলগত লক্ষ্য ৪ : বৈশ্বিক পর্যায়ে নিরাপদ খাদ্য ও পুষ্টি এবং বাণিজ্য সহজীকরণে বিএফএসএ এর ভূমিকা বৃদ্ধি করা।
া কৌশলগত লক্ষ্য ৫ : (নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক বৈজ্ঞানিক/কারিগরি কর্মকান্ডের কার্যকারিতা দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে বাড়ানো।
া কৌশলগত লক্ষ্য ৬ : খাদ্য নিরাপদতা এবং পুষ্টির ক্ষেত্রে সমস্ত অংশীজনদের সক্ষমতা তৈরি করা।
া কৌশলগত লক্ষ্য ৭: নিরাপদ এবং পুষ্টিকর খাবারের চাহিদা বাড়াতে ভোক্তা সচেতনতা তৈরি করা
নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩ এর উদ্দেশ্য পূরণকল্পে কর্তৃপক্ষ সংশি¬ষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞজন এবং অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে আইনের ৮৬ ও ৮৭ ধারা অনুযায়ী অদ্যাবদি ৩টি বিধিমালা ও ১১টি প্রবিধানমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করে চলছে।
অভিযোগ ও মতামত গ্রহণের জন্য হটলাইন নাম্বার ১৬১৫৫ চালু করা হয়। খাদ্য নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা কার্যক্রম বেগবান এবং খাদ্যপণ্য পরীক্ষা ও রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে দেশে বিদ্যমান খাদ্য পরীক্ষাগারসমূহের জন্য অনলাইন খধনড়ৎধঃড়ৎু ওহভড়ৎসধঃরড়হ জবঢ়ড়ংরঃড়ৎু সফটওয়্যার প্রণয়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া খাদ্যপণ্যের স্ট্যান্ডার্ড হারমোনাইজেশন তৈরি ও রপ্তানিকারকদের জন্য খাদ্যপণ্যের অনলাইন স্বাস্থ্য সনদ ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে বিএফএসএ এর নিজস্ব টিম কর্তৃক ১১৪৯৮টি খাদ্যস্থাপনা (পাইকারি বাজার, খুচরা বাজার, কাঁচা বাজার, রেস্টুরেন্ট, খাদ্য কারখানা ইত্যাদি) পরিদর্শন করা হয়।
পানির নমুনা পরীক্ষা
২০২২-২৩ অর্থবছরে চট্টগ্রাম, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর ও ঝালকাঠি জেলা হতে মনিটরিং ও অভিযোগের ভিত্তিতে প্রেরিত ১৮টি পানির নমুনায় আর্সেনিক (অং), মারকারী (ঐম), সীসা (চন), ক্যাডমিয়াম (ঈফ), ঝধষসড়হবষষধ, ঊ. পড়ষর, ঋবপধষ পড়ষরভড়ৎস ব্যাকটেরিয়া পরীক্ষা করা হয়। ফলাফল বিশে¬ষণ করে গোপালগঞ্জ হতে প্রেরিত ৪টি পানির নমুনায় ঋবপধষ পড়ষরভড়ৎস,ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায় যার উপস্থিতি মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ঋবপধষ পড়ষরভড়ৎস ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেলে পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
কোমল পানীয় ক্যাফেইনের পরিমাণ নির্ণয় বিষয়ক গবেষণা
২০২২-২৩ অর্থবছরে কোমল পানীয়ের ২৬টি নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার ফলাফল বিশে¬ষণ করে দেখা যায়, বাংলাদেশ স্টান্ডার্ড ইউঝ ১১২৩:২০১৩ (ঞযরৎফ জবারংরড়হ) অনুযায়ী ২৬টি কোমল পানীয়ের নমুনার মধ্যে ০৯টি নমুনায় ক্যাফেইন এর মাত্রা অনুমোদিত মাত্রা ১৪৫ মি.গ্রা:/লি. এর সামান্য উপরে পাওয়া যায়। এছাড়াও ফ্রুট সিরাপে ক্যাফেইন এর উপস্থিতি রয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে মোবাইল ল্যাবরেটরির মাধ্যমে পরীক্ষিত নমুনার ফলাফল
কর্তৃপক্ষের মোবাইল ল্যাবরেটরি দ্বারা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ঢাকার বিভিন্ন স্থান হতে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, সবজি, ভোজ্যতেল, পাউরুটি ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্যের মোট ৩০০টি নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যে আলফাটক্সিন গ১, অ্যাবামেক্টিন, অ্যান্টিবায়োটিকের অবশিষ্টাংশ, ডিটারজেন্ট ও হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড এর উপস্থিতি পরীক্ষার সকল নমুনার ফলাফল গ্রহণযোগ্য হিসেবে পরিলক্ষিত হয়।
এছাড়া সবজির ১০টি নমুনায় সাইপারমেথ্রিন ও ১০টি নমুনায় কার্বোফুরান কীটনাশকের অবশিষ্টাংশ পরীক্ষা করে ফলাফল সর্বোচ্চ সহনীয় মাত্রার নিচে পাওয়া যায়। ৫৮টি পাউরুটির নমুনায় পটাশিয়াম ব্রোমেটের উপস্থিতি শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হয় এবং সকল নমুনায় পটাশিয়াম ব্রোমেটের উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয় নাই।
মোবাইল ল্যাবের মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন স্থাপনার ভাজা-পোড়া খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত তেলের টোটাল পোলার কমপাউন্ড এর পরিমাণ পরীক্ষা করা হয় এবং ৭৯টি পরীক্ষিত নমুনার মধ্যে ১৪টিতে অগ্রহণযোগ্য মাত্রায় পোড়া তেল লক্ষ করা যায়। তাছাড়া ১৬টি ফর্টিফাইড ভোজ্যতেলের নমুনায় ‘ভিটামিন এ’ এর পরিমাণ পরীক্ষায় ৫টি নমুনায় মাত্রা বহির্ভূত ফলাফল পাওয়া যায় (চিত্র-১ দৃষ্টব্য)। ভিটামিন এ পরীক্ষার নমুনা পুনঃপরীক্ষণের জন্য ল্যাবে প্রেরণ করা হয়।
নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রম
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বছরব্যাপী উপজেলা/জেলা/বিভাগীয় পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের অংশগ্রহণে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতামূলক ৩১৬টি কর্মসূচি সুশীলসমাজ ও খাদ্যকর্মীদের নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে অবহিতকরণ শীর্ষক ০৫টি সেমিনার এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে নিরাপদ খাদ্যের ভূমিকা শীর্ষক ৬৫টি কর্মশালাসহ সর্বমোট ৩৮৬টি সেমিনার/কর্মশালা/কর্মসূচি সম্পন্ন করা হয়। উক্ত কর্মসূচিতে মোট ১১,১৪৮ জন অংশীজন অংশগ্রহণ করেন।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশব্যাপী খাদ্যকর্মীদের অংশগ্রহণে ২২০টি প্রশিক্ষণ আয়োজন করা হয়েছে যেখানে ৬,৯৮০ জন খাদ্যকর্মীকে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১২ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ‘নিরাপদ খাদ্যবিষয়ক পারিবারিক নির্দেশিকা’ এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়েছে। পারিবারিক পর্যায়ে ১,১৫,০০০ নির্দেশিকা বিতরণ হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের মাঝে নিরাপদ খাদ্য বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সূচনালগ্ন হতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেমিনার/কর্মসূচি আয়োজনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ৪৯৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেমিনার/কর্মসূচি আয়োজন করে এবং এতে প্রায় ৪৯,৫০০জন শিক্ষার্থীকে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে অবহিত করা হয়।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক ২০২২-২৩ অর্থবছরে গবেষণা অনুদান প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয় হতে গবেষণা প্রস্তাব আহ্বান করা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান হতে মোট ১১৪টি গবেষণা প্রস্তাব পাওয়া যায়। উক্ত গবেষণা প্রস্তাবসমূহ কারিগরি ও প্রেজেন্টেশন মূল্যায়নের ভিত্তিতে মোট সাতটি গবেষণা প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫০% অর্থাৎ ৩৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে এবং বাকি অর্থ আগামী বছরে নীতিমালা অনুযায়ী প্রদান করা হবে।
বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার জন্য শুধু খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয় বরং নিরাপদ ও পুষ্টিসম্মত খাদ্যের মাধ্যমে অপুষ্টির অভাব দূর করে সুস্থ সবল মেধাবী জাতি গঠন নিশ্চিত করতে হবে। দেশের খাদ্য শৃঙ্খলের বিভিন্ন ধাপে বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন হতে খাবার টেবিল পর্যন্ত খাদ্যকে জনগণের জন্য নিরাপদ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
দেশে মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য সংস্থানের মাধ্যমে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ, এসডিজির অভীষ্টসমূহ অর্জনে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল নিয়োগ, কর্তৃপক্ষের কার্যপরিধি সম্প্রসারণ এবং বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্যশৃঙ্খলের নিরাপদতার মান উন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা পালন করছে।
লেখক : সচিব, বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, খাদ্য মন্ত্রণালয়, বিএসএম অফিস কমপ্লেক্স (ভবন ২), ১১৯ কাজী নজরুল ইসলাম সড়ক ঢাকা। ফোন : ২২২২২৩৪৩৬, ই-মেইল :secretary@bssa.gov.bd